Ad Code

অনুসন্ধান

6/recent/ticker-posts

Saraswati Puja

 

                                আরাধনা

                                 

                                   (১)

 

    - সভাপতির নাম কি? বেশ ধমকের সুরে ওদের প্রশ্নটা করি।

    - বিট্টু।

    - না বিল্টু!

    - না না অভিষেক!!   তিনজন তিন রকম উত্তর দিল।

 

     -ঠিক করে বল কে তোদের সভাপতি? আর একবার ধমক দিই।

     -ইয়ে মানে........! এক রকম দেখতে দুটি ছেলের একজন আমতা আমতা করে উত্তর দিল। অভি, অভিই ফাইনাল।

      বুঝলাম হয় ওদের ত্রয়ী সভাপতি। না হলে ওদের সবাই সভাপতি। না হলে অদের কোন সভাপতিই নেই। ধমেক কারনেই হোক বা অন্য কোন অজানা কারণে  ঠিক নাম বলতে পারল না কেউ।

    

     সন্ধ্যেবেলা বাড়ি থেকে বের হতে যাচ্ছি। সেই সময় মূর্তিমান বিট্টু অভি আরো দুটো ছেলে আমার বের হওয়ার পথ অবরোধ করে দাঁড়ালো। ওদের বয়সটা বেশ কিছু বছর হল কাটিয়ে এসেছি। অর্থাৎ ওরা পাড়াতে আমাদের পরের জেনারেশন। রোয়াকের দাবীদার। একটু পরখ করে দেখছিলাম, ওরা আমাদের উত্তর উত্তরাধিকার হওয়ার উপযুক্ত কিনা!

 

      সকলেই মুখচেনা তবু পরিচয় জানতে চাইলাম। যে দুজনের নাম জানতাম না তারা পাড়াতে নতুন এসেছে। জমজ ভাই। সেই কী বলে না টুইন্স বেবী, ঠিক তাই। এদের ডাকনাম, খারাপ করে বললে, খারাপ নাম এক্কা আর দোক্কা। আমি ভাবলাম দোক্কা ছোটটির নাম। কিন্তু না বড়টির নাম দোক্কা আর ছোটটি এক্কা। বাবামায়েরদের কী উচ্চ বিচার।

 

      এক্কাকে জিজ্ঞেস করলাম কি খেলতে ভালবাসিস? মুখটা রাগ রাগ করে শুধু বললো, ক্রিকেট!

      -ডন ব্যাডম্যান কোথাকার মানুষ জানিস?

      অন্যদের মুখ থেকে উত্তরটা কেড়ে নিয়ে বিট্টু জবাব দিল, যে দেশে স্টিভ ওয়া থাকে সেই দেশে। মুখের মত জবাব পেয়ে একটু থতমত খেলাম। এবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলাম।

      সবার নাম ধাম ইস্কুল জিজ্ঞাসা করতে করতে তা প্রায় মিনিট দশেক পার হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে কেউ কেউ অস্থির হয়ে উঠেছে। কিছু পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছে কয়েকজন। কিন্তু একজন নাছোড়বান্দা। ভাবখানা এই, এতক্ষণ ধরে পাঁয়তারা করলে চাঁদু! কিছু তো ছাড়তেই হবে। অবশেষে আমার কি দুর্মতি হল দিয়ে দিলাম একটা গোটা কয়েন। দিয়ে ভাবছি কতই দিলাম।

      মনে মনে হিসাব করছি মাসে কটা দিন  বাকি এখনও। একটা টিউশনি ছুটেছে। কোনমতে দুটো টিঁকে আছে তার মধ্যে মালতির বাবা দৈবাৎ মাসের পঁচিশ তারিখের আগে টাকাটা দিলে হয়। খুশিতে একসঙ্গে এক প্যাকেট চ্যান্সেলর কিনি। ব্যাটার আবার চিটে গুড়ের ব্যবসা। মাধববাবু সেদিকে এক কথার মানুষ। কিন্তু ছেলেটা আবার হার বিচ্চু। ওকে এদের দলে ভিড়িয়ে দিলে দুদিনে এদের উপর খবরদারি করবে। একদিন আমাকে ওর ঘোড়া হতে হয়েছিল। দৃশ্যটা ভাবুন একবার। মাস্টারের ঘাড়ে খোকা দোলে সিন!

     আমি ভাবছি এবার হয়তো ওরা আমার পদবী সহ নাম জিজ্ঞাসা করবে। এবং সেখানেও একটা বড় প্যাঁচ দেব। যাচককে প্যাঁচে ফেলতে এত ভালো লাগে যে কি বলব। এ সুখ যে না পেয়েছে, সে বুঝবে না। কিন্তু না! ওরা এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। বুঝতে পারলাম এত কষ্টের পর। এই দক্ষিণাতে মন ভরেনি। আরো চাই।

     - আরে ভাই আমরা যখন পুজো করতাম, ওই হাতাতেই জান কয়লা হয়ে যেত। আর আমিতো না চাইতেই . . . !!!

    

      ঠিক এই সময় পাশের গলি থেকে এক মামণির আগমন। দিন না দাদা বচ্ছরকার দিনে একবার আসি . . .। এদের দলে প্রমিলারা আছে আগে বুঝিনি । জানলে এতো ঘাটাতাম না। আমি পুরো ঘেঁটে আমাদের সময় চাঁদা, পুজোর ফান্ডিং ছেলেদের একচেটিয়া ব্যাপার ছিল। মেয়েদের দৌঁড় ঐ নৈবিদ্যের আয়োজন আর পুষ্পাঞ্জলী পর্যন্ত ছিল। এখানেও ভাগ বসালি মা(মণি) আমার।

      নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। হয়ত এই প্রবচনে বিশ্বাসী একটি ছেলে চাঁদার বিলটা কাটলো। রীতিমত শাঁসিয়ে গেল স্কুলে অঙ্কের মাস্টারী পেলে বেশি না দিলে কোন ছাত্রের জ্যামিতি বক্সেই কোনদিন চাঁদা থাকবে না।

 

     বাড়তি পেয়ে মামণী একটা হাল্কা হাসিতে বিদ্ধ করে, বিদেয়

হল।

 

                                (২)

 

      পুতুলদি, সিং ভেঙে ছোটদের দলে ঢুকে জোগাড়ের সমস্ত আয়োজন সুসম্পন্ন করেন। পুতুলদির নাম কেন পুতুল হল তার গল্প অন্যদিন করব। কোথাও কিছু নেই, মাঘ মাসের সকালে কোথা থেকে এত মেঘ এসে জমা হল জানা নেই। চারিদিক অন্ধকার করে আকাশ যেন ছাদে নেমে এল। মাঘে শ্রাবনের মেঘ সকল উদ্যোগীকেই যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলল। আমিও বাদ গেলাম না!

     

      একদিন ওদের মধ্যে ওদের মতো বয়স আমিও কাটিয়েছি। এই তো সেদিন পলাশের দাদুর ধুতি চুরি করে পুজোর প্যান্ডেল বানিয়েছিলাম। দাদু ছিলেন পূজারী ব্রাহ্মণ। ওদের বাড়িতে অর্থের অভাব থাকলেও ধুতি গামছার অভাব ছিল না কোনোকালে। আমরা সেবার জোড়া মার্কিন কাপড়ের ডামি হিসেবে সিলেক্ট করেছিলাম ধুতিকে। পুজোর বাজেট আর প্রতিমার উচ্চতা অনুযায়ী একখানা ধুতিতেই হয়েযেত। পলাশের উপর ধুতি জোগাড় করার ভার পরে। পুজোর একদিন আগেই ধুতি আনার কথা। কিন্তু পুজোর আগের দিন দুপুরেও পলাশ আর ওর ধুতির পাত্তা নেই! তবে কি ধুতি জোগাড় করতে গিয়ে পলাশকে পলাশীর যুদ্ধ করতে হচ্ছে?

 

      আমরা ধুতির আশা ছেড়ে দিয়ে মায়েদের কাপড় দিয়ে ম্যানেজ করার কথা ভাবছি। এমন সময় পলাশ এসে হাজির। মুখে একরাশ অসন্তুষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করলাম পেয়েছিস? ও গর্বের সঙ্গে হেসে উত্তর দিলো পাবনা মানে? আমার নামও পলাশ চাটুজ্জে।

     

      তা এতোক্ষণ দেখতে পাইনি কেন? ভয়ে ভয়ে ভজা জিজ্ঞেস করল।

 

      ওকে ভরসা দিয়ে পলাশ বললো, দুপুরবেলা সবাই ঘুমিয়ে পরার পর দাদুর ঘরে খাটের নিচ থেকে ধুতি ভর্তি ট্রাঙ্কটা টেনে বের করেছি। দাদু টেরটিও পর্যন্ত পাইনি।  টপাটপ করে ব্যাগে ভরতের যাবো। এমন সময় ডান কাঁধে চাপড়।

 

       ধুত্তরি!!! ফিরে দেখি পেছনে মা দাঁড়িয়ে আছেন। নিচের তলার ঘরে শুয়ে ছিলেন। মেঝেতে ট্রাঙ্কের ঘষড়ানিতে মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় নিয়ে যাবি?

 

     তাহলে ধুতি পাসনি? জানতে চাইলাম। কারণ হাতে কোন ঝোলা ছিল না পলাশের। কথার জবাব না দিয়ে পরনের ধুতি খুলে ফেলল পলাশ। বলল, ভেবেছিলাম বলবো না। ধরা পরে গিয়েছি।

 

      একটু নিঃশ্বাস নিয়ে পলাশ বলল,  মা একটার বদলে দুটো ধুতি দিয়েছেন। ঠিক হলো একটা দিয়েই প্যান্ডেল বানাবো। আর দ্বিতীয়টা, দ্বিতীয়বার পলাশের দাদুর হাতে তুলে দেব। দক্ষিণা হিসেবে।

 

      প্রসাদ বিতরণ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। এবার পুরুত বিদায় পালা। চাটুজ্জে মশাই ধুতিটা হাতে নিয়ে মিটমিট করে হেসে বললেন, এটি তোমাদের কাছেই রাখো। পরের বছর কাজে লাগবে। আমরা ক্লিন বোল্ড।

    

     হটাৎ কলিং বেল। আমি খুলতে গিয়ে আবার গুগলির সামনাসামনি হতে হল। সেই ষোড়শী। সেই চোখ। বলল, দাদা পুজো শুরু হয়েগেছে দাদা। কেউ পুষ্পাঞ্জলি দিতে চাইলে তাড়াতাড়ি আসুন। ঠাকুর মশাই এক রাউন্ড বল করবেন থুড়ি মন্ত্র বলবেন। আজ ওনার স্লঘ ওভার ডিম্যান্ড। আমি



 (৩)

দুপুর যত বিকেলের রূপান্তরিত হতে থাকে, আকাশের মুখ আরো গোমরা হয় ছোট ছোট ছেলেপিলেরা হঠাৎ কি পাপ করেছে বোঝা দায়হটাৎ দেবীর উপর এই রোষানল কেন?

সারাদিন গুলিয়ে ঠিক সন্ধ্যাবেলা হাওয়া অফিসের সমস্ত আগাম ঘোষণাকে উপেক্ষা করে প্রবল বাতাস বইতে শুরু করে সঙ্গে বৃষ্টি। বিল্টু একমাত্র ছেলে, ওর উপর ভার পড়ল বাটি পোঁতার। বাটি পুঁততে গিয়ে সে এক্কেবারে কেলেঙ্কারি ব্যাপার। নির্দেশিকায় মাটি কে খুঁড়বে? অর্থাৎ দ্বিতীয় বা তৃতীয় সন্তান, এক্ষেত্রে যোগ্য কিনা বলা নেই। তাই প্রত্যেকে ল্যাজে গোবরে থুড়ি কাঁদায় কাপড়ে, এই থুড়ি কাঁদা জলে নাকানি চোবানি খেয়ে খ্যান্ত হয়।

এরপর ঠিক হয়, আকাশের দিকে তাক করে ঝাঁটা দেখানোর পরিকল্পনা কেউকেউ দেখায়, কিন্তু ছাতার নিচে ঝাঁটা সিনেমাও ফল্প হয় সমস্ত তুকতাক উপেক্ষা করে অকাল বর্ষণ শুরু হয়

থামবার কোন মনোভাব না দেখিয়ে, টানা চার ঘণ্টা বৃষ্টি চলল। সঙ্গে ঝড়। বরুণদেব ও ইন্দ্রদেবের সমবেত কনসার্টে পার্বতীর কনিষ্ঠা কন্যার আরাধনায় গেল গেল রব উঠল।

এরমধ্যে কে এসে খবর দিল ওদের প্যান্ডেল উঁড়ে পাশের বাড়ির কার্ণিশে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। এখুনি কিছু একটা না করলে। আরো দূরে রওনা দেবে। ঝড় রুপি ক্রিস গেইলের ছক্কা ইডেন উদ্যান থেকে বল রুপি প্যান্ডেল হাই কোর্টের এজলাসে গিয়ে পড়ার যোগার। দে ছুট, দে ছুট . . .। সকলে দৌঁড়ায়।

না। বেদমাতা আস্ত আছেনওদের পুজোয় গলাগলি মেম্বার নজন। একটা গোটা টেস্ট টিমও হবে না। পদ্মসনার মাথায় ছাতা ধরে বসে আছে দোক্কা অভিষেকের সামনে মাধ্যমিক পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার সময় ডাকতে বলেছিল। বাকিরা প্যান্ডেল বাঁচানোর দায়িত্ব কেউ নেয়নি কারণ বাঁচানোর মতো প্যান্ডেলই তো হয়নি শুভঙ্করীকে প্যান্ডেল থেকে সরিয়ে বাঁচানো গেছে পুজোর সময় তার বাগদেবীকে চিনতে পারবেন ঠাকুরমশাই।

 

প্রকৃতি বিরূপ হতেই পারেমানুষ বড়জোর মানুষের উপর দোষারোপ পাল্টা দোষারোপ করে সাময়িক স্বস্থি পেতে পারে। তাই প্রলয় মিটতেই প্যান্ডেল ওয়ালাদের দোষারোপ করে পুষিয়ে নিল সব্বাই।

 

প্রায় সিকিদিন কাটিয়ে ধরা আবার ধরিনী হয়। এবং পুজোর উদ্যোক্তাদের দীর্ঘশ্বাস শান্ত হয়। সারদার সরঞ্জাম পুনঃস্থাপন করে তার চ্যালারা। 

 

পুজোর আগে কোন বারোয়ারিই আগাম টাকা দেয় না। তাই ঠিক হল বাকি টাকা আর মেটানো হবে না। কিন্তু না দিলে পরের বছর কি আর কেউ প্যান্ডেল করবে? প্যান্ডেল ওলারা বাঁশের বিসনেশ করে। যদি ওই বাঁশ প্রত্যেক উদ্যোক্তার পশ্চাতে দেয়! কি বিষম বিপদ। একটা মাত্র পিতৃ প্রদত্ত . . .।

কেন তারা খুঁটি জোরদার দেয়নি? ত্রিপল কেন গগনভেদী? তার জবাব কেউ আদায় করতে পারবে না। তাই আস্ফালন, আস্ফালনের স্তরেই থেকে যায়। বাস্তবে সকলেই চাঁচা আপন পরাণ বাঁচা বাছা পাবলিক হয়ে, পাশ ফিরে শুরে পরা স্ট্যান্ড নেয়।

 

আশপাশের  বারোয়ারীর থেকে নিজেদের বারোয়ারি নিরাপদে আছে জেনে, অভিরা শান্ত হয়। মাঘ মাসে শেষ কবে পৃথিবীর এই রূপ দেখেছে তাই নিয়ে বড়রা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ক্ষান্ত হন। ছোটরা এই ভেবে শান্ত হয় যে তারা যেটা প্রত্যক্ষ করল তা আগে কেউ দেখেনি!

কোনোক্রমে উতরে গেছে এটাই দেবী সারদার কৃপা।

রাতে আকাশ সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে গেল। পরের দিন আবার সবকিছু ঠিকঠাক। ওদের ঠাকুর পুজোর পর একদিন রেখে বিজয় করায় রীতি। পূজার পরের দিন পাড়ায় গ্র্যান্ড ফিস্ট অথবা ভুরিভোজের চল। এখানে সকল দায়িত্ব আর তরুণদের হাতে  ন্যস্ত থাকে না। পরিবর্ত প্লেয়ার হিসাবে ম্যাচের দায়িত্ব নেয় বড়রা। অর্থাৎ আমরা। মানে আমি আর পেল্লাদ।

আমি দায়িত্ব নিতে ভয় করিনা। কিন্তু ভয় করি সেই ষোড়শীকে। কখন কোথা থেকে এসে উদয় হয়ে আমার ভাবনার আকাশে প্রবেশ করে। সে কথা ভাবতে ভাবতেই আমার রাত কাবার হয়ে গেল।

 

 আমাদের ব্যাঁচে আর যারা ছিল, তারা অনেকেই কাজের  সূত্রে অথবা  পড়ার কারনে অন্যত্র প্রবাসী। আমি আর পেল্লাদ বাদে কেউ আমাদের সমবয়সী ছিল না।  কিন্তু পাড়ার পুজো তাই দায়িত্বটা কাধে তুলে নিলাম। উপরি যদি কিছু হয়, বেকার জীবনে প্রেম ছাড়া আর কিইবা কাম্য!

 আচ্ছা আমি কি প্রেমে পড়লাম? প্রেম যে করতেই হবে এমনটা নয়। প্রেম তো এভাবে বলে কয়ে আসে না। প্রেম হয়ে যায়। আমি ষোড়শীর মোহে আবদ্ধ হয়েছি। তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। ও দিকে প্রেম ক্রীড়ার থার্ড আম্পয়ার মুচকি হাসেন।

   

 

ক্রমশ্য প্রকাশ্য . . .


 


Reactions

Post a Comment

0 Comments