অন্য পদ্মনাভী জাতিকা
বাঙালীর চতুর্দশ পার্বণ দেবী শ্রীশ্রী রাজরাজেশ্বরী পুজো
দাদা, বাঙালির কটি পার্বণ
যেন? জানি বাঙালির খ্যাতিমত তেরো বলবেন। আচ্ছা, যদি আর একটা পার্বণ এতে যোগ হত,
কেমন হত? ভাবছেন এ কেমন রসিকতা করছি? না দাদা এটা রসিকতা নয়। একদম হাতে গরম সত্যি।
গরবাটী উত্তর চন্দননগরে তৎকালীন গড়ের বাজার এলাকায় সে সময়ের ব্যবসায়ী সমিতি আরাধনা
শুরু করেন দেবী দুর্গার আর এক প্রতিমূর্তি । দেবী শ্রীশ্রী রাজরাজেশ্বরীর পূজা। যা
আজ চন্দননগর তথা চুঁচুড়ার বাঙালিদের কাছে চতুর্দশ পার্বণে পরিণত হয়েছে।
কথিত আছে গড়ের বাজার এলাকায় স্থানীয়
ব্যবসায়ী সমিতি মায়ের পুজো আরম্ভ করেন। সেটা কত সাল, তা অনুমান সাপেক্ষ। এর পর
গঙ্গায় বহু জল বয়েছে। সরস্বতী নদী থেকে
হুগলী নদী শহরের জীবন ধারায় মিশেছে। গড়ের বাজারের বাজার লুপ্ত হয়েছে। দেবীর
আরাধনাও বন্ধ হয়েছে।
এর পর আনুমানিক ১৯২৮ সালে এলাকার কয়েক জন
প্রবীন ব্যক্তত্ব এক হয়ে আবার দেবীর পুজো শুরু করায় ব্রতী হন ––তাঁদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হলেন স্বর্গীয় নারায়ণ চন্দ্র নিয়োগী, কালীচরণ নন্দী, তুলসীচরণ সিংহ,
আশুতোষ ঘোষ, মহেন্দ্র নাথ দে, সন্তোষ কুমার দে, যোগীন্দ্র নাথ বিশ্বাস প্রমুখ। বর্তমান প্রতিমার সঙ্গে সে সময়ের প্রতিমার কিছু
পরিবর্তণ লক্ষ্য করা যায়। তখন মাটিতে তিনটি বাঁশের তৈরী পাটাতন করা হত। পাটাতনটি
তৈরী হত সিঁড়ির অনুকরনে। ওপরের পাটাতনে মহাকাল(শিব) যোগনিদ্রায় শুয়ে থাকতেন এবং
তাঁর নাভিস্থল থেকে উত্থিত পদ্মে দেবী উপবেশন করতেন। প্রতিমার দুই পাশে জয়া ও
বিজয়া বিরাজ করিতেন। আর নিচের পাটাতনে পঞ্চ দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর,
ইন্দ্র, পঞ্চানন করজোড়ে পদ্মাসনে বসিয়া থাকিতেন।
দেবীর পিছনে চালচিত্র থাকত এবং চালচিত্রের
মাঝখানে মাটির ঘড়ি থাকত। সপ্তমী থেকে দশমী চারদিন দেবীর পুজো হত। কিন্তু দশমীতে দেবীর বিসর্জন হত না। পুজোর
ঠিক একমাস পর পাটাতন থেকে দেবী মুর্তি বিচ্ছেদ করে গরুর গাড়ী করে গঙ্গায় বিজয়ার
মাধমে উৎসবের সমাপ্তি ঘোষণা হত। পুজোর চার দিন ব্যাপী কলকাতার বিখ্যাত যাত্রাপালা
অনুষ্ঠিত হত।
১৯২৮ সালে স্বর্গীয় কৃষ্ণচন্দ্র শেঠ
গড়বাটীতে জমি কিনে বর্তমান কল্কি সংঘের
সামনে বসবাস শুরু করেন। তাঁর মস্তিস্কে প্রথম আসে পুনরায় পুজো আরম্ভ করার কথা।
তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তাঁর বন্ধু স্বর্গীয় পাঁচুগোপাল ঘোষ । মূলত এই দুই
ব্যক্তির ঐকান্তিক ইচ্ছা ও এলাকার সুধি জনের সহযোগিতায় পুজোর পুনারাম্ভ হয়।
এই উপলক্ষে এক সাধারণ সভার আয়োজন করেন কৃষ্ণচন্দ্র
শেঠ মহাশয় নিজের বাড়িতে। চন্দননগরের তৎকালীন দুই গুণী পন্ডিত যথাক্রমে হরিচরণ
পন্ডিত(ঝানু ঠাকুর) ও কালীদাস ঘটকের নির্দেশে প্রতিমা নির্মান করেন জয়দেব
পাল(ধানু) । হোগলার আটচালা বেঁধে পুজো আরম্ভ হয়।
প্রতিমার বর্তমান রূপের ব্যাখ্যা হিসেবে
পন্ডিতরা বলেন, সৃষ্টির শুরুতে সমস্ত জগৎ ছিল জলমগ্ন। ব্রহ্মাণ্ডে কোথাও উদ্ভিদ বা
প্রাণী ছিল না। শুধুই জল আর জল। তখন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা চিন্তা করলেন এইবার
পৃথিবীতে প্রাণী সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু প্রাণী সৃষ্টির জন্য চাই প্রকৃতি।
তখন ব্রহ্মা শরণাপন্ন হলেন বিষ্ণুর। শ্রীবিষ্ণু বললেন, সমুদ্রগর্ভে রত্নসিনহাসনে
মহাকাল যোগনিদ্রায় মগ্ন। তাঁর নাভিস্থল থেকে প্রস্ফুটিত পদ্মে জগৎজননী মা
চতুর্ভূজা বসে আছেন। তাঁকে সমুদ্র গর্ভ থেকে তুলে এনে আরাধনা কর। তবেই দেবী
প্রকৃতি ও প্রাণীকূল সৃষ্টি করবেন। তখন পঞ্চ দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, পঞ্চানন
ও ইন্দ্র মিলে রত্ন সিংহাসন সমেত কাঁধে করে দেবীর উদ্ধার করেন। তিনিই বর্তমানে
পুজিত দেবী রাজরাজেশ্বরী। যেহেতু পঞ্চ দেবতা কাঁধে করে ধরে আছেন তাই এনারা
দন্ডায়মান । এই গেল দেবীর সৃষ্টি রহস্য ও প্রারম্ভিক ইতিহাস।
এবার বলি সমসাময়িক কিছু কথা, বর্তমানে শ্রী
পঞ্চমীর দিন(সরস্বতী পুজো) কাঠামো পুজো হয়। এবং এর ঠিকএক মাস পরে শুক্লা তিথিতে
সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমী এই চার দিন পুজো হয়। দশমীর দিন রাতে শোভাযাত্রা সহকারে
দেবীর ভাসান হয়। পুজো উপলক্ষ্যে প্রায় সপ্তাহ ব্যপী এলাকায় মেলা থাকে। পুজোর
চারদিন দু’বেলা এক পক্তিতে দরিদ্র নারায়ণ সেবা ও ভোগ বিতরণ করা
হয়। এছাড়া থাকে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্টান বস্ত্রদান, গান বাজনা ইত্যাদি। প্রায়
প্রতিদিন উপস্থিত থাকেন রাজ্য তথা দেশের কোন না কোন কৃতি মানুষ।
মন্দির প্রাঙ্গন ছারিয়ে স্থানীয় কল্কী
সংঘের মাঠে বর্তমানে মেলা বিস্তৃতি লাভ করেছে। নিকটবর্তী অঞ্চলে দেবী
রাজরাজেশ্বরীর আরাধনা আর কোথাও হয় না। ভিন্ন তিথিতে কোন্নগরে এই পুজোর চল আছে। ক্রমে
বারোয়ারী ও পুজোর শ্রী বৃদ্ধি ঘটছে। কমিটি কল্কি সংঘের সংলগ্ন জমি কিনেছেন।
স্থানীয় উৎসবটিকে আরো সুষ্ঠ ভাবে পরিচালনার স্বার্থে। শীতের শেষে চন্দননগর ও
চুঁচুড়ার মানুষের এই বাড়তি পাওনা বাঙালির উৎসব মুকুটে একটি বাড়তি পালক জুড়ে
দিয়েছে।

0 Comments